মিশ্র অক্সাইড (Mixed oxide)

 

শুরুতেই এরকম শিরোনাম দেখে ভয় পাবার কিছু নেই! একটা কথা বলে রাখি, কেবল ধাতুরাই মিশ্র অক্সাইড গঠন করে! আশা করি তোমরা অক্সাইড কি তা জানো! এখন মূল প্রসঙ্গে আসা যাক!

 

মিশ্র অক্সাইড কিন্তু ধাতুদের বিভিন্ন অক্সাইডের মিশ্রণ নয়! এটা বলে দেবার কারণ হচ্ছে, তোমরা অনেকেই হয়ত মিশ্রণ হতে মিশ্র শব্দটি এসেছে বলে ধারণা করবে…!

কিন্তু বিষয়টা আসলে হচ্ছে, কোনো একটি অক্সাইড যৌগে যদি একই ধাতব পরমানুর একাধিক যোজনী প্রদর্শিত হয়, তখন সেটিকে মিশ্র যোজনী প্রদর্শনমূলক অক্সাইড বলে!

 

তোমরা হয়ত এখন আমাকে প্রশ্ন ছুঁড়বে, একই অক্সাইড যৌগে একই ধাতব মৌলের একাধিক যোজনী প্রদর্শন! এটা আবার কেমন কথা…?

 

এখন তোমরা নিশ্চয়ই জানো, কিছু ধাতব মৌল পরিবর্তনশীল যোজনী(variable valency) প্রদর্শন করে! এটা তোমরা ৯ম-১০ম শ্রেণীতে পড়ার কথা! ধাতুদের বেলায় এই পরিবর্তনশীল যোজনীর মধ্যে নিম্ন যোজনীকে আস(ous) যোজনী এবং উচ্চ যোজনীকে ইক(ic) যোজনী বলে। যেমনঃ Cu (কপারের ল্যাটিন নাম Cuprum) দুটি যোজনী প্রদর্শন করে, 1 এবং 2 ।

নিম্ন যোজনীবিশিষ্ট কপার আয়নটি হচ্ছে কিউপ্রাস(Cu+1) আয়ন এবং উচ্চ যোজনীবিশিষ্ট কপার আয়নটি হচ্ছে কিউপ্রিক(Cu+2) আয়ন।

 

এখন এরকম পরিবর্তনশীল যোজনী Fe, Pb, Hg, Ag, Au, Sn, Mn, Pt এরা-ও দেখায়!

 

এখন আবার কপারে ফেরত আসা যাক!

 

Cu2O কিউপ্রাস অক্সাইড

CuO কিউপ্রিক অক্সাইড

এখন এই দুটি কপারের অক্সাইডকে যোগ করলে…মানে কপার পরমানুর সংখ্যা একসাথে আর অক্সিজেন পরমানুর সংখ্যা একসাথে, তাহলে পাবে-Cu3O2, এটিকে-ই বলা হয় কপারের মিশ্র অক্সাইড!

 

খেয়াল করলে দেখবে…এখানে ৩টি কপার পরমানুর মধ্যে ২টি কপার পরমানুর যোজনী ১, আর বাকি ১টি কপার পরমানুর যোজনী ২, মোট (১*২)+(২*১) = ৪, আর ২টি অক্সিজেন পরমানুর যোজনী ২*২ = ৪… তাহলে উভয় পরমানুর যোজনীর সমতা সাধন ঠিক আছে।

 

এখন খেয়াল করলে দেখবে, এই অক্সাইডটিতে কপারের দুটি যোজনী (সহজ কথায় একাধিক) পরিলক্ষিত হয়েছে, যেটিকে আমরা আসলে কপারের মিশ্র যোজনী প্রদর্শনমূলক অক্সাইড সংক্ষেপে মিশ্র অক্সাইড বলছি!

 

 

এরকম আরো উদাহরণ হচ্ছে… (FeO + Fe2O3 Fe3O4 /ফেরোসোফেরিক অক্সাইড),

(PbO + PbO2 Pb2O3 /লেড সেসকুই অক্সাইড)

 

এতক্ষণ তোমরা যা দেখলে সেগুলি হচ্ছে… একই ধাতব মৌলের একই যৌগে একাধিক যোজনী প্রদর্শনমূলক অক্সাইড, কিন্তু এখন যেটি নিয়ে আলোচনা করব সেটি হচ্ছে-একই ধাতব মৌল-ই যে হতে হবে মিশ্র অক্সাইডের বেলায়, এটি সত্য নয়! বরং কোনো একটি অক্সাইডে যদি ভিন্ন ভিন্ন ধাতব পরমানু বিদ্যমান থাকে, তখন-ও সেটিকে মিশ্র অক্সাইড বলে! হয়ত কথাটা হজম করতে একটু কষ্ট হচ্ছে! একটা উদাহরণ ব্যাখ্যা করলে আশা করি সব পানির মতো সহজ হয়ে যাবে…!

 

NaAlO2    সোডিয়াম অ্যালুমিনেট

Na2ZnO2 সোডিয়াম জিঙ্কেট

 

খেয়াল করে দেখবে, এই অক্সাইডগুলোতে একই ধাতব মৌলের পরমানু না হয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধাতব মৌলের পরমানু বিদ্যমান! প্রথমটিতে Na এবং Al আর দ্বিতীয়টিতে Na এবং Zn। তাই এগুলোকে-ও মিশ্র অক্সাইড বলে!

 

কিন্তু এখন তোমাদের মনে যে প্রশ্নটি আসতে পারে, সেটি হচ্ছে এই দুটি যৌগের নাম এরকম কেন?

 

তাহলে বলে রাখি, এরা মূলত অক্সাইড এবং সেই সাথে লবন-ও! হ্যা, লবন/salt!

 

আর লবনদের নামের শেষে আইড(ide) / আইট(ite) / এট(ate) বসে! উদাহরণঃ ক্লোরাইড(Cloride) লবন, ফসফাইট(Phosphite) লবন এবং নাইট্রেট(Nitrate) লবন!

 

আর তোমরা অন্তত এটা জানো, লবন একটি প্রশম পদার্থ, যেটি অম্ল ও ক্ষারের বিক্রিয়া হতে গঠিত হয়!

 

যেমনঃ

NaOH + HCl NaCl (সোডিয়াম ক্লোরাইড) + H2O

 

NaOH + HNO3 NaNO3 (সোডিয়াম নাইট্রেট) + H2O

 

3NaOH + H3PO3 Na3PO3 (সোডিয়াম ফসফাইট) + 3H2O

 

এখানে খুব সহজ কতগুলি উদাহরণ আমি দিয়েছি, কিছু concept বোঝানোর তাগিদ! 

 

খেয়াল করলে দেখবে, এখানে উৎপন্ন লবনগুলির ধাতব আয়নটি এসেছে ক্ষার হতে এবং অধাতব অংশটি এসেছে এসিড হতে! এই জন্য ধাতব আয়নটিকে অম্লমূলক এবং অধাতব আয়নটিকে ক্ষারমূলক বলা হয়। লবনের নামকরণে ক্ষারমূলকের নাম আগে বসে আর অম্লমূলকের নাম পরে বসে! এটা ৯ম-১০ম শ্রেনীতে তোমরা পড়ার কথা! 

 

 

এখন খেয়াল করলে দেখবে, এখানে উদাহরণে যে এসিডগুলি ইক এসিড(হাইড্রোক্লোরিক এসিড,নাইট্রিক এসিড) এদের দ্বারা গঠিত লবনের নামের শেষে আইড(ক্লোরাইড)/এট(নাইট্রেট) বসে! আর যে এসিডটি আস এসিড (ফসফরাস এসিড) এদের দ্বারা গঠিত লবনের নামের শেষে আইট(ফসফাইট) বসে!

এগুলো অম্ল-ক্ষারের একদম গোড়ার কথা! এখন আসি আমাদের ওই মিশ্র অক্সাইড দুটির(সোডিয়াম অ্যালুমিনেট, সোডিয়াম জিঙ্কেট) এরূপ নামকরণের কারণে…!

 

তাহলে আমরা অন্তত এতটুকু বুঝতে পারছি যে, এদের নামকরণ বুঝতে হলে আমাদেরকে এটা জানতে হবে যে, এরা মূলত কোন দুটি অম্ল-ক্ষারের বিক্রিয়া হতে এসেছে…!

 

এখন আপাতত তোমাদের বেশি মাথা ঘামাতে হবে না, আমি বিক্রিয়া দুটি উল্লেখ করে দিচ্ছি।

 

1.   Al2O3 + 2NaOH  2NaAlO2 (সোডিয়াম অ্যালুমিনেট) + H2O

 

এখানে NaOH ক্ষার, কিন্তু Al2O3 এসিড হিসেবে আচরণ করছে! এখন Al2O3 এই প্রশমন বিক্রিয়ায় AlO2 আয়ন সরবরাহ করে, যেটিকে অ্যালুমিনেট আয়ন বলা হয়! তাই লবনটির নাম সোডিয়াম অ্যালুমিনেট। 

 

 

 

 

 

2.   ZnO + 2NaOH   Na2ZnO2 (সোডিয়াম জিঙ্কেট) + H2O

 

এখানে ZnO এসিড হিসেবে আচরণ করছে! এবং ZnO এই প্রশমন বিক্রিয়ায় ZnO2 আয়ন সরবরাহ করে, যেটিকে জিঙ্কেট আয়ন বলা হয়! তাই লবনটির নাম সোডিয়াম জিঙ্কেট!

 

3.   Al2O3 + Zn(OH)2  ZnAl2O4 (জিঙ্ক অ্যালুমিনেট) + H2O

 

এখন তোমরা হয়ত বলবে, এখানে অ্যালুমিনেট আয়ন কোথায় আছে? আমি বলছি আছে, একটু দাড়াও!

 

Al2O42- →  2AlO2

 

[ব্যাকগ্রাউন্ডে চন্ঞ্চল চৌধুরীর টেউটিনে আলকাতরার বিজ্ঞাপনের ডায়ালগ- “একটু চালাক না হইলে দুনিয়াতে টিকে থাকা মুশকিল!]

 

ভালো কথা, Al2O3 এবং ZnO উভধর্মী(Amphoteric) পদার্থ! মানে এরা এসিড এবং ক্ষার উভয় হিসেবে আচরণ করে! এই টপিক নিয়ে আরেকদিন লিখতে বসব!

 

তোমাদের জন্য একটা বাড়ির কাজ দেওয়া হচ্ছে…সেটি হচ্ছে সোডিয়াম টেলুরিয়েট এর সংকেত এভাবে বিক্রিয়া থেকে লিখতে হবে!

 

তারপর-ও তোমাদের জন্য কিন্ঞ্চিত clue দিয়ে দিই! খেয়াল করে দেখবে, এখানে মিশ্র অক্সাইডটির নামের শুরু হয়েছে সোডিয়াম দিয়ে, যেটি ধাতব মূলক! আর লবনে ধাতব মূলক আসে ক্ষার হতে, তার মানে এটি অবশ্যই NaOH!

 

আর তাহলে common sense হতে বলে ফেলা যায়, টেলুরিয়েট আসবে টেলুরিয়াম অক্সাইড হতে, যেমনটা অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড হতে অ্যালুমিনেট এবং জিঙ্ক অক্সাইড হতে জিঙ্কেট এসেছে।

 

এখন টেলুরিয়াম অক্সাইডের সংকেত আমি উল্লেখ করছি না, নিজেরা জানার চেষ্টা কর।

 

তোমাদের কাছে এই শেষের বিক্রিয়াগুলো (১, ২, ৩ নং বিক্রিয়া) একটু কঠিন লাগতে পারে, তবে এখানে বিক্রিয়াগুলো সহজে লেখার জন্য একটা টেকনিক আছে!

সেটি হচ্ছে আগে ভাগে বিক্রিয়ার ডানপাশে উৎপাদের দিকে ১ অনু পানি লিখে ফেলা (১, ২, ৩ নং বিক্রিয়ায় purple রঙে লেখা ১ অনু পানি) !

 

তারপর প্রয়োজন অনুসারে সমতা করে বিক্রিয়াটি সম্পন্ন করা।

 

এই শেষ কথাটা যে ধরতে পারবে, তার জন্য আশা করি, এই সমস্ত ব্যাপারটি ইতিমধ্যেই বোধগম্য হয়ে গেছে…!

 

আশা করি, মিশ্র অক্সাইড নিয়ে আর কোনো কিছুই তোমাদের জানার বাহিরে রইলো না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *