
প্রত্যেক শতাব্দীতে হাত গোনা কয়েকজন মানুষ জন্মায় যারা সভ্যতা সমাজের আমূল পরিবর্তন সাধন করে চিরকালের জন্য গতানুগতিক ধারাকে বদলে দেয়। নিউটন থেকে শুরু করে আইনস্টাইন পর্যন্ত কিংবা মাইকেল ফ্যারাডে থেকে নিয়ে নিকোলা টেসলা। অথবা এই একবিংশ শতাব্দীর সফটওয়্যার জগতের শিরোমণি বিল গেটস থেকে পার্সোনাল কম্পিউটার ও আ্যনিমেশান জগতের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব স্টিভ জবস এদের প্রত্যেকের অবদান ও প্রভাব আমারা প্রতি পদে পদে উপলব্ধি করতে পারি। একটু অন্যভাবে বলতে গেলে এদের অবদান ছাড়া আধুনিক জীবনযাত্রা কল্পনায় আনাও কঠিন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান সময়ে ওইসব সফল ব্যক্তিদের একদম যোগ্য উত্তরসূরী হল ইলন মাস্ক( Elon Musk)।
তো কে এই ইলন?
ইলন মাস্কের জন্ম ২৮ ই জুন ১৯৭১, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়াতে। ইলন এর পুরো নাম ইলন রিভ মাস্ক( Elon Reeve Musk), যদিও তিনি ইলন মাস্ক নামে সর্বাধিক পরিচিত। ইলন এর পিতা ইরল মাস্ক(Errol Musk) একজন ছোটোখাটো প্রকৌশলী এবং মা মায়ে মাস্ক(Maye Musk) একজন মডেল এবং ডায়াটিশিয়ান, মা জন্মসূত্রে কানাডা নিবাসী হলেও শৈশব ও যৌবন কেটেছে সাউথ আফ্রিকায় আর বোধহয় সেইজন্যই ইলন এর একাধিক নাগরিকত্ব দেখা যায়; সাউথ আফ্রিকা, কানাডা ও কর্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক। এছাড়া ইলন এর এক ভাই ও এক বোন আছে তাদের নাম যথাক্রমে কিম্বাল মাস্ক(Kimbal Musk) ও টোসকা মাস্ক(Tosca Musk)।
ছোট থেকে ইলন খুবই কৌতুহলী প্রাণশক্তিতে ভরপুর এবং নতুন কিছু জিনিষ খুব সহজেই আয়ত্ত করে নিতে পারত। ইলনের মায়ের ভাষায়…”He seemed to understand things quicker than the other kids”. আরেক অদ্ভুত ব্যাপার হল মাঝে মাঝে ইলন তার নিজের খেয়ালের মধ্যে এতটাই ডুবে থাকতো যে কেউ ডাকলেও কোনো সাড়া দিত না, তাই তার বাবা-মা ভাবলো যে এটা তার কোন সমস্যা তাই তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হলো, ডাক্তার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভাবলো আ্যডিনয়েড গ্ৰন্থি অপসারণ করলে হয়তো ইলন এর শ্রবনশক্তির উন্নতি হবে কিন্তু তাতে কিছু হল না, কারণ তারা ইলনকে বুঝতে ভুল করেছিল।
উক্ত বিষয়ে ইলনের মায়ের বক্তব্য…”He goes into his brain, and then you just see he is in another world.” এরদ্বারা সহজেই বোঝা যায় ইলন ছোট থেকে তার কল্পনার জগত বা বিচিত্র চিন্তা ভাবনায় মশগুল থাকতে পছন্দ করতেন। এইরকম স্বভাবের জন্য তার তেমন কোনো বন্ধু ছিল না কারণ তারা ইলনকে বদমেজাজি কিংবা অদ্ভুত ভাবত।
পাঁচ অথবা ছয় বছর বয়স থেকেই ইলন কোনো একটা কাজের প্রতি এতটাই মনোযোগ দিতে পারত আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে পৃথিবী থেকে ও যেনো বিচ্ছিন্ন। ইলন ওর মনের চোখ দিয়ে ওর কল্পনা গুলো ছবির মতন এবং প্রতিটি বিষয়ের খুব গভীর পর্যন্ত দেখতে পেত, যাকে আমরা বর্তমান সময়ের কোনো সফটওয়্যার চালিত 3D মডেলিং সাথে তুলনা করতে পারি আর যা আমাদের আইনস্টাইন এর ‘Thought Experiment’ এরকথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ইলন এর নিজের কথায়..” For images and number I can process their interrelationships and algorithmic relationships.”
তো এইভাবেই ত্বরণ, ভরবেগ, গতিশক্তি এবং এসব দ্বারা কোনো বস্তু কেমন প্রভাবিত হয় ও এই সংক্রান্ত জটিল ফিজিক্স ইলনের কাছে খুবই স্পস্ট হয়ে পড়ে। ইতিহাসের আর সব জিনিয়াস দের মতন ছোট থেকে ইলনেরও পড়াশোনা ও নতুন কিছু জানতে প্রবল আগ্রহ। বলা হয় যে ইলনকে কখনও কেউ খালি হাতে দেখেনি,সর্বদাই হাতে কোনো না কোনো বই, ঘন্টা দশেক পড়ে কাটানো তার কাছে জলভাত! সপ্তাহের শেষে ইলন দিনে দুটো বই পড়ে ফেলত। যেসব বই দশ বারো বছর বয়সী ইলনের চিন্তা ভাবনার জগৎ কে সূদুর এ প্রসারিত করেছিল তার মধ্যে অন্যতম হল,’Encyclopedia Britannica’ আর এইসময় থেকে তার সায়েন্স ফিকশনের প্রতি আগ্ৰহ জন্মায়।
তার পছন্দের কিছু বই হল Isaac Asimov এর ‘Foundation Series’ এবং Robert Heinlein এর ‘The Moon is a harsh mistress’, তবে তার বেশি প্রিয় এবং তার উপর বেশি প্রভাব ফেলেছিল যে বইটি তা হল Douglas Adams এর ‘The hitchhiker’s guide to the galaxy’
দশ বারো বছর বয়সে ইলন নিজের চেস্টায় প্রোগ্ৰামিং শিখে ‘Blaster’ নামের একটি ভিডিও গেম তৈরি করেন যা পরে স্থানীয় একটি ম্যাগাজিন কোম্পানিকে ৫০০ ইউএস ডলারে বিক্রি করে দেন যা বোধহয় তার জীবনের প্রথম উপার্জন।
তারপর ১৯৯২ সালে ইলন ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া থেকে ফিজিক্স ও ইকোনমিক্স এ গ্ৰ্যাজুয়েশান সম্পন্ন করেন। পরে Stanford ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করার আহ্বান পেলেও ইন্টারনেটের প্রতি আকর্ষণের জন্য তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
১৯৯৫ সালে ইলন তার ভাইকে সহযোগী করে ‘জিপ ২’ নামে একটি অনলাইন কোম্পানি শুরু করেন যা আজকের গুগল ম্যাপের প্রোটোটাইপ অনেকটা, আর ওই ওয়েবসাইট দ্বারা ইলন স্থানীয় পত্রিকা কোম্পানি গুলোর সিটি গাইড হিসাবে সাহায্য করত। পরে Compaq নামের অন্য এক কোম্পানি ‘জিপ ২’ কে ৩০৭ মিলিয়ন ইউএস ডলারে কিনে নেয় এবং ঐ বিক্রিবাবদ ইলন ২২মিলিয়ন ইউএস ডলারের মালিক হন। এর পরেই ইলন X.com নামের কোম্পানীতে সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যোগ দেন, যা পরে PayPal নামে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে যা অনলাইন মানি ট্রান্সফার এর জগৎ সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলে এইসময় তার সহকারী হিসেবে ছিলেন আর এক সফল উদ্যোক্তা পিটার থেইল। ২০০২ সালে বিখ্যাত ই-কমার্স কোম্পানি eBay ১.৫ বিলিয়ন ইউএস ডলারে PayPal কিনে নেয় এবং একজন বড় শেয়ার হোল্ডার হওয়ায় ইলন ট্যাক্স বাদে ১৮০ মিলিয়ন ইউএস ডলার অর্জন করেন। এবং এই বিপুল পরিমাণ অর্থের দ্বারা ইলন তার পূর্বপরিকল্পিত ড্রিমস প্রজেক্ট গুলো বাস্তবায়ন করবেন।
২০০২ সালের মে মাসে ইলন তার সঞ্চয়ের অধিকাংশ বিনিয়োগ করে ‘Space Exploration Technologies Corporations’ বা সংক্ষেপে SpaceX এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। রকেট সাইন্স এ ইলনের যথেস্ট জ্ঞান থাকার পাশাপাশি ইলন কিছু সুদক্ষ ও কর্মঠ লোকদের এক করেন যা SpaceX এর কাঠামোকে সুদৃঢ় করে। রকেট এর জগতের আমূল পরিবর্তন করে ইলনের কোম্পানি বাজারের তুলনায় অনেক কম মূল্যে এবং পুনরায় ব্যবহার করা যাবে এমন রকেটের উদ্ভাবন করে, তার সাথে রকেট ইঞ্জিনেরও প্রভূত উন্নতি সাধন করে। কয়েকবার ব্যার্থতা এবং ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপি আর্থিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার পর ২২ শে ডিসেম্বর ২০১৫ সালে SpaceX সাফল্যের মুখ দেখে। এর পর ২০১৮ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ফ্যালকন হেভীর সফল উৎক্ষেপণ হয়, যা ছিল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ক্ষমতাশালী রকেট এবং রকেটি ইলনের গাড়ি টেসলা রোডস্টার বহন করে মহাকাশে নিয়ে যায়।
এবার আসা যাক টেসলার গল্পে! ২০০৩ সালে Martin Eberhard ও Marc Tarpenning টেসলা মোটর নামের একটি গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি স্থাপন করে যা পরে ইলনের কাছে হস্তান্তর হয়। ২০০৮ সালে ইলন টেসলার সিইও এবং প্রধান ডিজাইনার হিসেবে যোগ দেন। এবং সম্পূর্ণ তড়িৎ চালিত এবং অটোনমাস গাড়ি তৈরির মাধ্যমে প্রথম সারিতে জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমানে টেসলার বাজার মূল্য ৪০০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি। টেসলার এই আকাশচুম্বী সাফল্যের পিছনে আর এক কারন হল উন্নতশীল দেশগুলো ভূগর্ভস্থ জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব যানবাহনের চাহিদা যা টেসলাই পূরণ করছে তার সাথে মনোমুগ্ধকর ডিজাইন তো আছেই।
ফিজিক্স এর সহজ ও জটিল বিষয়বস্তু থেকে কিভাবে সফল ব্যবসায়ীক পরিকল্পনায় রূপান্তর করা যায় এতে ইলন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং এখনও পর্যন্ত ও সফল সব ক্ষেত্রেই!
ইহা ছাড়া ইলন আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম সোলার কোম্পানির সাথে যুক্ত। সর্বদা যা হয়ে থাকে ইলনের পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা বরাবর ওর প্রতিযোগিদের থেকে শত মাইল দূরে। যাতায়াত ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটাতে ইলন ২০১৩ সালে হাইপারলুপের ধারণা পেশ করেন যা কিনা বিশেষ এক টিউবের মাধ্যমে linear induction motor ও air compressor কে কাজে লাগিয়ে ঘন্টায় ১২০০ কিলোমিটার বেগে ছুটতে পারবে যা বর্তমানে এর সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। আবার ট্রাফিক সমস্যা এড়াতে মাটির নিচ দিয়ে টানেলের মাধ্যমে যান চলাচল করানোর জন্য ইলন ‘ The Boring Company’ র সূচনা করেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা(Artificial Intelligence)নিয়ে স্টিফেন হকিং সহ বিশ্বের তাবড় তাবড় চিন্তাবিদরা শঙ্কা প্রকাশ করলেও ইলন এবিষয়ে আশাবাদী। তাই এই সংক্রান্ত গবেষণার জন্য প্রতিস্ঠা করেন ‘OpenAI’ যা মানবকল্যাণে AI কে ব্যবহার করতে সাহায্য করবে। বর্তমানে ইলনের যে কোম্পানি নিয়ে কল্পনা জল্পনা তুঙ্গে তা হল ‘Neuralink’। ইলন বিভিন্ন প্রান্তের নিউরোসাইন্টিস্ট ও টেকনিশিয়ান দের একত্রিত করে এবং নিজের ১০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ২০১৬ সালে এর যাত্রা শুরু হয়। যার প্রধান কাজ হল কম্পিউটার ও মস্তিষ্কের সমন্বয় সাধন, ২০২০ সালে শুকরের উপর এর সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এবং ইলনের নিজের কথায়….OpenAI ও Neuralink পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
ব্যক্তিগত জীবনে ইলন দুইবার বিয়ে করেছেন (যদিও একজনের সাথে দুইবার বিয়ে করেছেন, মোট তিনবার হয় দুবার ধরলাম!) কিন্তু দুবারই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হন! বর্তমান তিনি গায়িকা গ্ৰাইমস(Grimes) এর সাথে সম্পর্কে রয়েছেন এবং তিনি ৭ সন্তানের জনক।
এতগুলো ক্ষেত্রে এবং এত ভিন্নমুখী ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় ইলন কিভাবে টিকে গেলো! বর্তমানে ইলনের নিজস্ব সম্পদের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি! এতগুলো বিষয় একজন মানুষ দ্বারা কি সম্ভব?
এই ব্যাপারে ইলনের বক্তব্য খুবই সাধারণ, যত তুমি সময় ব্যায় করবে কোনোকিছুর পেছনে সে বিষয়ে তুমি ততো যোগ্য হয়ে উঠবে, আর যত বড়ো সমস্যার সমাধান করবে তত বেশি অর্থ উপার্জন করবে।
ইলন এত অসম্ভব সমস্যার সমাধান কিভাবে করেছেন তা জানতে হলে…..
এক ইন্টারভিউতে ইলন বলেন ” one of the really tough things is figuring out what questions to ask” “once you figure out the questions, then the answer is relatively easy. I came to the conclusion that really we should aspire to increase the scope and scale of human consciousness in order to better understand what questions to ask.”
তার আত্মদর্শন কিংবা অনুপ্রেরণা অথবা জীবনের লক্ষ্য তার নিজের কথায় একলাইনে বলতে গেলে…
“The only thing that makes sense to do is strive for greater collective enlightenment.”
© Md Zahid Ansari
Please read and give your valuable suggestions as a critic not friend!
Source:
1. Ashlee Vance’s book ‘Elon Musk’
2. Various interview of Elon
3. Internet
4. Bloomberg, Time magazine, Forbes , Business Insider, alux.com.