জীববিজ্ঞান

ক্যান্সার: এক অভিশাপ

ক্যান্সার,‌ বাংলায় অনুবাদ করলে হয় কর্কট। ছোট বড় সকলেই কমবেশি এই‌ নামের সাথে পরিচিত। ক্যান্সার নামটি শোনা মাত্রই এক সহজাতবোধ থেকেই আমারা মৃত্যুকে এর সাথে জুড়ে দেই, আর যারা একটু সচেতন বা জানেন তারা জিজ্ঞাসা করেন ক্যান্সার কোন‌ স্টেজে আছে তিন না চার!

ক্যান্সার শব্দের উৎপত্তি জানতে হলে আমাদের সেই‌ বিখ্যাত প্রাচীন গ্ৰীকদের নিকট যেতে হবে। বিখ্যাত গ্ৰীক চিকিৎসক হিপোক্রেটস্(৪৬০-৩৭০ খৃস্ট পূর্বাব্দ) সর্বপ্রথম দুধরনের টিউমার কে বোঝাতে ‘কারসিনোস'(Carcinos) এবং কার্সিনোমা (Carcinoma) শব্দ দুটি ব্যবহার করেন। সম্ভবত ওই নাম দুটি থেকে পরবর্তী কালে ক্যান্সার নামের জন্ম হয়। আরেক গ্ৰীক‌ চিকিৎসক গ্যালেন(১২৯-২১৬ খৃস্টাব্দ) টিউমার কে বলতেন অঙ্কস(Oncos) যা থেকে অঙ্কলজি (Oncology)(ক্যান্সার সংক্রান্ত বিদ্যা) শব্দের উৎপত্তি এবং যারা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ তাদের অঙ্কলজিস্ট(Oncologist) বলা হয়।

ক্যান্সারের অস্তিত্ব বহু পুরানো তা আমরা জানতে পারি জীবাশ্মভূত হাড়ে টিউমারের চিহ্ন হতে কিংবা প্রাচীন মিশরীয়দের মমি, বিশেষ করে মমির‌ মধ্যে হাড়ের ক্যান্সার বা Osteosarcoma এর সন্ধান মিলেছে এবং এসব‌ মমি আনুমানিক ৫০০০ বছরের পুরনো। ক্যান্সারের বণর্না ‌আছে এমন সবচেয়ে পুরনো দলিল হল ওই মিশরীয়দের লিপিবদ্ধ প্যাপিরাস যা Edwin Smith Papyrus নামেও পরিচিতি এবং ওই লিপিতে ৮ ধরনের ‌টিউমারের বর্ণনা ‌পাওয়া এমনকি তখনও বলা ছিল এ রোগের কোনো চিকিৎসা ‌নেই।

ইউরোপে রেঁনেসার পর‌ থেকে‌ জ্ঞান বিজ্ঞান এর ক্ষেত্র প্রসারিত হতে লাগলো তার সাথে সাথে চিকিৎসাবিদ্যা ও মানব শরীর সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্যও আবিস্কৃত হতে লাগল। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে Giovanni Morgagni সর্বপ্রথম ক্যান্সার গবেষণায় বৈজ্ঞানিক ধারার সৃষ্টি করেন আরও পরে এক স্কটিশ সার্জেন জন হান্টার বলেন কিছু প্রকার ক্যান্সার সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়। আঠারো শতকে কোষবিদ্যায় প্রসিদ্ধ নাম Rudolf Virchow বিশ্বাস করতেন ক্যান্সার শরীরে ছড়ায় তরল‌ পদার্থের ধর্মের ন্যায় কিন্তু এই ধারণা রদ করেন একজন জার্মান চিকিৎসক Karl Thiersch এবং তিনি বলেন ক্যান্সার ছড়ায় মেটাস্ট্যাসিস পদ্ধতিতে এবং ম্যালিগন্যান্ট কোষ দ্বারা।

এইভাবে ধীরে ধীরে ক্যান্সার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ও চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নতি ঘটেছে। এবং বর্তমানেও এই শাখায় নিরন্তর গবেষণা হয়ে চলেছে। আগেই জানালাম প্রাচীন মিশরীয়রা ক্যান্সারের কিছু প্রকারভেদের সাথে পরিচিত ছিল এবং এখন আমরা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কল্যাণে ১২০ এর অধিক ‌ক্যান্সারের প্রকারভেদ সম্পর্কে জানতে ‌পারি। সাধারণত যে ক্যান্সার‌ গুলো বেশি দেখা‌ যায়‌ তা‌ হল ফুসফুসের ক্যান্সার, অগ্ন্যাশয় ও যকৃতের ক্যান্সার , স্তন ক্যান্সার,‌ গলার পাশ্ববর্তী অংশে ‌এবং প্রস্টেট ক্যান্সার ইত্যাদি।

ফুসফুসের ক্যান্সার আবার দুধরনের হয়ে থাকে, মূলত ধুমপানের কারণে এই ক্যান্সার হয় তবে যারা ধুমপান করেন না তাদের ও হতে পারে। এটি বায়াপসি ও ব্রঙ্কস্কপি পদ্ধতি প্রয়োগ করে অনেকাংশে নির্মুল করা যায়। আমাদের মিশ্র গ্ৰন্থি অগ্ন্যাশয় এর ক্যান্সারের ও কিছু ভাগ আছে এটি নির্ভর করে টিউমার বহির্ভাগে হয়েছে না অভ্যন্তরীণ এ হয়েছে।

অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের শনাক্ত করা হয় CT scan ও PET(positron emission tomography) এর মাধ্যমে। 

এবার জেনে নেওয়া যাক ক্যান্সার কি এবং এটি কিভাবে ছড়ায়!

খুব সহজ করে বললে ক্যান্সার হল আর‌ পাঁচটা রোগের মতো এক রোগ কিন্তু আর সব রোগ থেকে এর পার্থক্য হল এর প্রকারভেদ অনেক এবং দেহের সব জায়গায় হতে পারে এবং জটিল তো বটেই!

যখন কোনো বিশেষ কারণে দেহের কোন অংশে অতিরিক্ত হারে কোষ বিভাজন(proliferation) হয়‌ যার ফলে দেহের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয় তাকে ক্যান্সার বলে। আমাদের স্বাভাবিক কোষের বিশেষ এক ধর্ম আছে যাকে বলে Contact Inhibition যার দ্বারা কোনো কোষ তার আশেপাশের ‌কোষগুলোর অপ্রয়োজনীয় বৃদ্ধি বা বিভাজন রোধ করে কিন্তু ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ এই ধর্মকে হারিয়ে ফেলে আর তখনই বহু সংখ্যক কোষ জমাট বেঁধে টিউমারের সৃষ্টি করে।

ক্যান্সারের এই টিউমার আবার দুই ভাগে বিভক্ত একটি বিনাইন টিউমার আর অপরটি হল ম্যালিগন্যান্ট টিউমার । বিনাইন টিউমার উৎপত্তিস্থলেই থাকে দেহের অন্য অংশে ছড়ায় না তাই তুলনামূলক ভাবে কম ক্ষতিকারক। অপরপক্ষে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার খুব দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায় এবং পাশের সব কোষ এবং ‌কলায় খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে এমনকি রক্তের মাধ্যমে ও দেহের অন্য অংশে টিউমার তৈরিতে সক্ষম। এই ধর্মকে মেটাস্ট্যাসিস বলে যা ক্যান্সার কোষের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ধর্ম।

আনবিক পর্যায়ে ক্যান্সারের কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের ডিএনএ এর কথায় আসতে হবে । আমরা সকলেই জানি এই ডিএনএ অনেক বেস পেয়ার এর সমন্বয়ে গঠিত যার সংখ্যা ‌কমবেশি ৩ বিলিয়ন , প্রত্যেক মানুষের ডিএনএ বেস সজ্জাও ভিন্ন এবং এগুলি আবার ২৫০০০ জিনের সমন্বয়ে গঠিত এবং এই জিন গুলো কোষদের নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। আমারা যখনই বলি কোনো ‌কোষ ক্যান্সার কোষে রুপান্তরিত হয়েছে তার মানে ওই কোষটির জেনেটিক কোড ও এপিজেনেটিক কোডের পরিবর্তন হয়েছে যার ফলে উক্ত কোষটির সাধারণ আচরণ বিঘ্নিত হচ্ছে এবং তা অতিরিক্ত কোষ বিভাজনে অংশ নিচ্ছে।

যদিও একটি স্বাভাবিক কোষকে খুব সহজে ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত করা যায় না। যখন ডিএন এ এর বেস সজ্জার অল্প পরিবর্তন হয় তাকে আমরা ইনিশিয়েসান বলি এবং বেশি ‌মাত্রায় পরিবর্তন হলে আমরা বলি প্রোমোশান এই দুটি পর্যায় পেরিয়ে তবে কোনো কোষ ক্যান্সার কোষে পরিণত হয় যার‌ জন্য অনেক সময় লাগে।

জিন সম্পর্কে আমাদের কমবেশি ধারণা সবার রয়েছে। ক্যান্সারের জন্য দায়ী জিনকে অঙ্কোজিন বলা হয়। অঙ্কোজিন এর পূর্ববর্তী দশার নাম প্রোটো অঙ্কোজিন এরা সাধারণত কোষের বৃদ্ধি তে সাহায্য করে কিন্তু মিউটেশনের(অথবা Chromosomal rearrangement ও gene duplication এর মাধ্যমে) মাধ্যমে প্রোটো জিনের পরিবর্তন ঘটে এবং অনেক প্রতিলিপির সৃষ্টি হয় তখন এটি সক্রিয় হয়ে অঙ্কোজিন এ পরিনত হয়, যার ফলে ক্যান্সার হতে পারে।

খুব অল্প সংখ্যক ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অঙ্কোজিন বংশগত কারণে প্রাপ্ত তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা‌ স্বাধীন ভাবেই অর্জিত।

বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে আমরা ‌দেখি যে ধুমপান ক্যান্সারের কারন। সত্যিই কি তাই?

এর উত্তর পেতে গেলে তোমাকে জানতে হবে যে ধুমপানের মাধ্যমে আমরা তামাক গ্ৰহন করি যা একপ্রকার কারসিনোজেন। সহজে করে বললে‌ কারসিনোজেন হল ক্যান্সারের কারণ বা যার সংস্পর্শে এলে আমাদের ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। এই কারসিনোজেন বাতাসে উড্ডয়মান কোনো পদার্থ হতে পারে, কোনো রাসায়নিক ‌যা আমরা খাদ্য ও পানীয় হিসেবে গ্ৰহন করছি তাও হতে পারে কিংবা যেটা আমার সকলে‌‌ প্রায় জানি সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিও একপ্রকার কারসিনোজেন, ইহা ছাড়া আরও অনেক কিছুই কারসিনোজেনিক পদার্থের অন্তর্গত।

কিছু কারসিনোজেনিক পদার্থের উদাহরণ হল তামাক, রেডন, ফর্ম্যালডিহাইড , আ্যলকোহল ইত্যাদি।

এছাড়া কিছু প্রকার ভাইরাস রয়েছে যাদের সংস্পর্শে ক্যান্সারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এদের আমরা ‌অঙ্কোভাইরাস বলি। কমপক্ষে ১২% ক্যান্সার হয় এইসব ভাইরাসের আক্রমনে। কিছু অঙ্কোভাইরাসের উদাহরণ হল EBV(Epstein Barr virus), HPV(Human papilloma virus) হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস (HBV, HCV)

এটা বলা হয় যে আগামীতে এমন কোনো বাড়ি থাকবেনা যে যেখানে ‌ক্যান্সার প্রবেশ করেনি, ধীরে ধীরে এই কথার সত্যতা প্রকাশ পাচ্ছে। যদিও সারা পৃথিবীর সব উন্নতশীল দেশের সব উজ্জ্বল মস্তিষ্ক গুলো রাতদিন গবেষণায় মগ্ন যা আশার আলো দেখায়।

এখনও পর্যন্ত আমারা বিভিন্ন উপায়ে ও পদ্ধতিতে ক্যান্সার মোকাবেলার চেষ্টা করেছি। তার কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করলাম।

প্রথমে যে পদ্ধতির কথা ‌বলতেই হয় তা তোমরা অনেকে শুনেছে, তা হল কেমোথেরাপি। এই থেরাপি তে বিভিন্ন রকমের ড্রাগ প্রয়োগ করে চিকিৎসা হয়। যেমন স্টেরয়েড হরমোন প্রয়োগে স্তন ক্যান্সার ও প্রস্টেট ক্যান্সার এর চিকিৎসা হয় আবার লিউকেমিয়ার জন্য কর্টিকোস্টেরয়েড এর ব্যবহার করা হয়। বর্তমান সময়ে একশোর অধিক ড্রাগ প্রয়োগে কেমোথেরাপি সম্পন্ন হয়।

কেমোথেরাপি এর পর‌ সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হল রেডিয়েশান থেরাপি, যেখানে এক্স রশ্মি, গামা রশ্মি কিংবা সাবএটমিক কনা নিউট্রন এর নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়।

আরেক গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি হল ইমিউনোথেরাপি। এই পদ্ধতিতে দেহের T-cell কে বাইরে এনে পুনরায় প্রোগ্ৰাম করে রক্তের মাধ্যমে দেহে প্রতিস্থাপন করা হয় এবং ওই T-Cell গুলো ক্যান্সার কোষগুলো শনাক্ত করে ওদের বিনাশ করে। ইমিউনোথেরাপিতে সবচেয়ে কার্যকরী মেথড হল CAR-T। যদিও এই পদ্ধতি অনেক ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন প্রকৃতির টিউমার ধ্বংস করতে এই পদ্ধতি অকার্যকর।

ইহা ছাড়া জিন থেরাপি তে রিকম্বিনেশষ ডিএন এ টেকনোলজি ও বোন ম্যারো ট্রানপ্ল্যান্টেসান এর মাধ্যমেও কিছু প্রকার ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়।

দিনশেষে আমরা এটা দেখি যে এখনও পর্যন্ত ক্যান্সারের কোনো নির্দিষ্ট সফল চিকিৎসা পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়নি, তাই আমরা গোটা বিজ্ঞানী মহলের দিকে তাকিয়ে আছি তারা ‌কি চ্যালেঞ্জে জয়ী হবে ? যেমনটা আমরা অতীতে অনেক রোগকে জয় করেছিলাম! এখন সেটা দেখার অপেক্ষায় গোটা মানবজাতি!

Source:

1. Biology Text book

2. www.britannica.com

3. www.cancer.org

4. www.cancer.net

5. American Cancer society

6. www.sanger.ac.uk

7. Image credit: Getty images

For further Reading:

1. A biography of cancer by Siddhartha Mukherjee

2. When Breath Becomes Air by Paul kalanithi ( a neuroscientist’s personal memoir on cancer and death)

© Md Zahid Ansari

Comment (1)

  1. DEWA
    December 13, 2020 Reply

    Proud of you. Bhi

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *